
জুরাইনে রেল লাইনের পাশ ঘেঁষে সারি সারি সাজানো হয়েছে কাঁচা সবজি, ফলসহ নিত্যপ্রয়েজনীয় পণ্যের পসরা। যখন ট্রেন আসছে তখন দ্রুত তা সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। অনেক সময় ঘটছে জীবনহানির মতো দুর্ঘটনা। এমন দৃশ্য দেখা যায় রাজধানীর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) জুরাইন রেললাইনে। নানা সময় রেললাইনের উভয় পাশের জায়গা থেকে এসব দোকান সরিয়ে দিলেও অদৃশ্য কারণে আবারও বসে। ফলে ছোট-বড় দুর্ঘটনা লেগেই আছে। কাঁচা বাজারের কারণে রেললাইনের প্রায় অর্ধেক পাথর সরে গেছে। যত্রতত্র পড়ে রয়েছে ময়লা আবর্জনা।
সরেজমিনে দেখা যায়, গেণ্ডারিয়ার ঘুণ্টিঘর থেকে শুরু করে জুরাইন লেভেলক্রসিং পর্যন্ত রেল সড়কের দুই পাশে প্রতিদিনই বসছে নানা পণ্যের দোকান। রেললাইনের উভয় পাশে প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকায় ছোট-বড় প্রায় ২০০ অস্থায়ী কাঁচা মালের দোকান। ট্রেনের হুইসেল শোনামাত্রই ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে শুরু হয়ে যায় দৌড়ঝাঁপ। ট্রেন চলে যাওয়ার পরপরই রেললাইন রূপ নেয় আগের অবস্থায়।
বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রেলের কিছু কর্মকর্তার প্রশ্রয়ে রেললাইন ঘেঁষে অবৈধ বাজার গড়ে উঠেছে। স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা রেলওয়ে পুলিশও অবৈধ দোকানিদের বাধা দেয় না। এ বাজার চলে সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। মূল বাজারের চেয়ে দামে সস্তা বলে এসব দোকানে ক্রেতাদেরও ভিড় বেশি।’
স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজারের কোলাহলে কখনো কখনো ট্রেনের হুইসেলের শব্দ শোনা যায় না। তাই প্রায়ই ঘটে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। এলাকাবাসীর অভিযোগ, বহুবার উচ্ছেদ করা সত্ত্বেও নিয়মিত তদারকির অভাবে জুরাইন রেলগেট এলাকায় রেললাইন ঘেঁষে বারবার বাজার বসে। স্থানীয় বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমাদের বহুদিনের দাবি, কাঁচা বাজারের নির্দিষ্ট কোনো জায়গা হোক। কিন্তু তা হচ্ছে না। বাধ্য হয়েই আমাদের এখানে আসতে হচ্ছে। আর দুর্ঘটনা এখানে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, প্রায়ই হচ্ছে। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের দ্রুত হস্তক্ষেপ করা উচিত।’ ফল ব্যবসায়ী সুরুজ আলী বলেন, ‘মাঝে মাঝেই সরকারি অভিযানে আমাদের উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু উচ্ছেদের পর আমরা আবার এসে বসি। কারণ, আশপাশে বসার কোনো জায়গা নেই। কী করব ভাই, গরিব মানুষ। কিছু একটা করে তো খেতে হবে। আমাদের তো অত পুঁজি নাই যে মার্কেটে গিয়ে দোকান দেব।’
পাশেই থাকা আরেক ব্যবসায়ী জহুর আলম বলেন, ‘ট্রেন এখানে এসে গতি কমিয়ে দেয়। দুর্ঘটনা এড়াতে মাঝে মাঝে থামিয়েও দেয়। তার পরও প্রতি মাসে এখানে পাঁচ-ছয়টি দুর্ঘটনা ঘটেই।’ এ বাজার নিয়ে মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী বলেছেন, ‘গেটম্যান থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্তৃপক্ষের কাছে যায় উত্তোলিত চাঁদার টাকা।’ রেললাইনে দোকান দিয়েছেন কাউকে ভাড়া দিতে হয় কি না? এমন প্রশ্নে সুলাইমান নামের একজন কাঁচামাল বিক্রেতা বলেন, ‘জিআরপি পুলিশ ভাড়া নেয়। থানা পুলিশও নেয়। প্রতিদিন ২০ টাকা করে ভাড়া দিতে হয়। তবে দোকান বড় হলে ১০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া দিতে হয়।’ কোনো রাজনৈতিক নেতা বা এদের কেউ ভাড়া নেয় কি—জানতে চাইলে বলেন, ‘কমিশনারের লাইনম্যান এসে টাকা নেয়। প্রায় সময় উচ্ছেদের পর দোকান বসাতে বেশি টাকা লাগে।’
বুয়েটের গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘ট্রেনের ইঞ্জিনের শব্দ কম, দ্রুতগতিতে চলে এবং অল্প দূরত্বে থামতে পারে না। এ জন্য দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আইনের কঠোর প্রয়োগের বিকল্প নেই।’ রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় এস্টেট কর্মকর্তা নুরুন্নবী কবির বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে পুলিশ না পাওয়ায় বেশ কিছু দিন রেলের ধারের অবৈধ দোকান উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ ছিল। শিগগির আবারও অভিযান শুরু হবে।’ এ বিষয়ে বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক আরিফুজ্জামান বলেন, ‘একবার উচ্ছেদ হলে আবার ভাসমান দোকানপাট গড়ে ওঠে। তবে বিভিন্ন স্থানে রেলের ধারের অবৈধ স্থাপনা নিয়মিত উচ্ছেদ হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে জুরাইনসহ নারায়ণগঞ্জ রুটের অবৈধ বাজারও উচ্ছেদ করা হবে।’















